টিকটকের মাধ্যমে পরিচয়। অতঃপর টিকটক স্টার বানানোর কথা বলে মগবাজার এলাকার এক তরুণীকে ভারতে পাচার করে দেয়া হয়। সেখানে ধারাবাহিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতনের শিকার ওই তরুণী কৌশলে ৭৭ দিন পর দেশে পালিয়ে আসেন।
ভারতফেরত ওই তরুণী জানান, সেখানে অবস্থান করার সময় তিনি আরও অনেক বাংলাদেশি তরুণীকে দেখেছেন। যারা বিভিন্ন সময়ে এই চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়েছেন। যিনি মঙ্গলবার (১ জুন) রাতে হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
পুলিশ জানায়, মামলায় ১২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজন বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন। মামলায় অভিযোগের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার (১ জুন) দিবাগত রাতে সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী দাবকপাড়া কালিয়ানী এলাকা থেকে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন- মেহেদী হাসান বাবু, মহিউদ্দিন ও আব্দুল কাদের। যারা ভারতে প্রায় এক হাজার নারীকে পাচারে সীমান্ত পার হতে সরাসরি সহায়তা করেছেন।
ভারতফেরত তরুণীকে যেভাবে পাচার
২০১৯ সালে হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে টিকটক হৃদয়ের সঙ্গে পরিচয় হয় ভুক্তভোগী ওই তরুণীর। কখনো টিকটক স্টার বানাতে চেয়ে, কখনো ভালো বেতনের চাকরির অফার দিয়ে ভিকটিমকে নানাভাবে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করেন হৃদয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নারায়ণগঞ্জের অ্যাডভেঞ্চার ল্যান্ড পার্কে ৭০-৮০ জনকে নিয়ে টিকটক হ্যাংআউট করেন হৃদয়। পরে একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের আফরিন গার্ডেন রিসোর্টে ৭০০-৮০০ জন তরুণ-তরুণীকে নিয়ে পুল পার্টির আয়োজন করা হয়। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় বাউল লালন শাহ মাজারে আয়োজিত টিকটিক হ্যাংআউটে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে এই তরুণীকে চক্রের অন্যান্যদের সহায়তায় সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পাচার করে দেন হৃদয়।
ওই তরুণী পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, ভারতে পাচারের পর তাকে ব্যাঙ্গালুরুর আনন্দপুর এলাকায় পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাসায় রাখা হয়। এ সময় ভারতে এ চক্রের দ্বারা পাচারকৃত আরও কয়েকজন বাংলাদেশি ভিকটিমকে সেখানে দেখতে পান। যাদেরকে সুপার মার্কেট, সুপার শপ বা বিউটি পার্লারে ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে পাচার করা হয়েছে।
৭৭ দিনের বীভৎস নির্যাতন
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ব্যাঙ্গালুরুতে পৌঁছানোর কয়েকদিন পরই ওই ভুক্তভোগী তরুণীকে চেন্নাইয়ের অয়ো (Oyo) হোটেলে ১০ দিনের জন্য পাঠানো হয়। সেখানে অমানবিক শারীরিক ও বিকৃত যৌন নির্যাতন করা হয় তাকে। সেখানে সামান্যতম দয়া কিংবা করুণা দেখায়নি চক্রের সদস্যরা।
কৌশলে নেশা জাতীয় দ্রব্য খাইয়ে কিংবা জোরপূর্বক বিবস্ত্র ভিডিও ধারণ করে পরিবারের সদস্য বা পরিচিতদের পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে জিম্মি করে রাখা হয়েছিল এই ভুক্তভোগী তরুণীকে। পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ার পর থেকে পালিয়ে দেশে ফেরা ওই কিশোরীর করা মামলার এজাহারে ও তদন্তে উঠে এসেছে লোমহর্ষক বর্ণনা, যা করুণ কাহিনী কল্পনাকেও হার মানিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে নির্যাতিত ওই তরুণীর সহায়তায় ভারতে পাচার হওয়া তিনজন দেশে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। যাদের একজন ভারতে পাচারের ৭৭ দিন পর দেশে ফিরেছেন, তিনিই হাতিরঝিল থানায় মামলাটি দায়ের করেন। বাকি দুইজন ভারতফেরত ভুক্তভোগীর নাম-ঠিকানা জেনে যোগাযোগের চেষ্টা করছে পুলিশ।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে ডিসি বলেন, পাচারের শিকার ও পাচারকারীরা অবৈধভাবে ভারতে যায়। তাদের কাছে ভিসা-পাসপোর্ট বা কোনো ধরনের বৈধ কাগজপত্র থাকে না। এরপর চক্রের ভারতীয়দের সহায়তায় সে দেশের আধার কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। যে কার্ড ব্যবহার করে তারা ভারতে মুভমেন্ট করে থাকেন।
পাচারকারী চক্রে কতজন জড়িত জানতে চাইলে ডিসি আরও বলেন, তদন্তের এ পর্যায়ে আমরা অনেকের নাম পেয়েছি। তদন্তের আরেকটু পর সংখ্যাটি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো। প্রথমে নির্যাতিত ভিডিও ভাইরালের ঘটনায় আমরা নিখিল নামে একজন ভারতীয়কে সে দেশের পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারের তথ্য পেয়েছি।
কমেন্ট করুন