শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৩৪ পূর্বাহ্ন

তিমিরা কি আসলেই আত্মহত্যা করে?

সৈকত
  • আপডেট করা হয়েছে শনিবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২১
  • ৩৪৪ বার পড়া হয়েছে

তিমিরা কি আসলেই আত্মহত্যা করে? সেটি বিজ্ঞানীদের কাছেও এখনও এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। তবে দুষণ, আহত হওয়া বা অন্যকোন কারণে তিমিদের গভীর সমুদ্র থেকে সৈকতমুখী হওয়া ও নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার যে প্রবণতা, তাকে ‘ধারণাগত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব’ বা হাইপোথিসিস অনুযায়ী ‘হুয়েল স্ট্র্যান্ডিং ইভেন্ট’ বা ‘তিমিদের আত্মহত্যা’ বলা হয়।

তিমিদের জীবন প্রণালীর একটি পর্যায় বা অবস্থা বুঝাতে এই পরিভাষাটিই ব্যবহৃত হয়ে আসছে এরিস্টটলের আমল থেকে বা প্রায় ২ হাজার ধরে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এর রিপোর্টে বলা হয়, বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ চিলির পাতাগোনিয়াতে ৩৩৭টি মৃত তিমি আবিষ্কার করেছেন, যেটি এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানের কাছে জানা সবচেয়ে বড় একক হুয়েল স্ট্র্যান্ডিং ইভেন্ট।

রিপোর্টে বলা হয়, গত কয়েকমাসে তিমিরা ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ভারত, যুক্তরাজ্য এবং নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

ডলফিন, তিমি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর শ্বাস নেয়ার জন্য ওপরে ওঠে আসে। আবার শিকারের জন্য তারা সাগরের অনেক গভীরে চলে যায়। এমনকি তারা এক কিলোমিটার গভীরে গিয়েও শিকার ধরে আনে। কিন্তু এ ভারসাম্য বিঘ্নিত হলে বা যথাযথভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে ব্যর্থ হলে তিমিরা ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে। এসময় তারা জোয়ারের সাথে সৈকতের দিকে চলে আসে এবং সৈকতে এসে আটকা পড়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে পতিত হয়।

অসুস্থতা, বার্ধক্য কিংবা তীব্র জোয়ারের প্রভাবে তিমিদের ব্লু-হোল (যে অঙ্গের মাধ্যমে তারা শ্বাস নেয়) শ্বাস গ্রহণ বাধাপ্রাপ্ত করে। এই নিউমোনিয়া অবস্থায় তারা সৈকতমুখী হয়। বিশ্বব্যাপী তিমিদের মৃত্যুর অর্ধেক ঘটনাই ঘটে বিচিং বা সৈকতমুখী হওয়ার কারণে।

দূষণ, শিপিংয়ের শব্দ এবং কিছু ক্ষেত্রে সামরিক সোনার বা শব্দ তরঙ্গের প্রভাবে তিমিরা সৈকতমুখী হয় বলে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। উত্তর-পূর্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউমোনিয়া স্ট্র্যান্ডিং একটি সাধারণ কারণ। তিমি বা ডলফিনে হাঙ্গর এর আক্রমণ বা একই প্রজাতির অন্য সদস্যদের আক্রমণে এই ধরনের ট্রমা তৈরি হয়।

বিষাক্ত ‘লাল জোয়ার’ সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণীর উপরও প্রভাব ফেলে। কিছু ক্ষেত্রে চুম্বকীয় ক্ষেত্রের অনিয়মের সাথেও এই ধরনের ঘটনা সম্পর্কিত বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। পানি দূষণ (যেমন তেল ছড়িয়ে পড়া, ইউট্রোফিকেশন, অ্যালগাল ফোটার) এবং পরিবেশগত বিষাক্ততা ছাড়াও ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গীরির অগ্নুৎপাতের মতো কারণও চিহ্নিত করা হয়েছে তিমির মৃত্যুর জন্য। তবে যে কারণেই তাদের মৃত্যু হোক না কেন, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অসুস্থ সঙ্গীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে না সুস্থ সঙ্গীটি। আর এই সোশ্যাল কেয়ারিং বা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে অসুস্থ সঙ্গীর সহায়তায় তার পিছু নিয়ে সুস্থ সঙ্গীটিও নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। আর তিমিদের এ প্রবণতা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে ‘আত্মহত্যারই সামীল’।

গত ৯ ও ১০ এপ্রিল কক্সবাজারের হিমছড়ি সৈকতে একজোড়া তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে। দুইদিনই আমি ঘটনাস্থল পর্যবেক্ষণ করে ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছি। প্রথমদিন যে মৃত তিমিটি ভেসে এসেছিল, সেটি আহত ছিল না। সেটি ছিল মহিলা। কিন্তু পরের দিন উদ্ধারপ্রাপ্ত তিমিটি ছিল পুরুষ। তার মেরুদন্ডের হাড় মারাত্মকভাবে ভাঙ্গা পাওয়া যায়। আঘাতের গভীরতা ছিল প্রায় ৬ ফুট বাই ২ ফুট। পরে ভেসে এলেও এই তিমিটি আসলে আগেই মারা গিয়েছিল বলে তার শরীরের পঁচন দেখে আমার মনে হয়েছে।

কিন্তু কক্সবাজারে দুই তিমির মৃত্যুর কারণ নিয়ে মিডিয়া আমার মন্তব্য জানতে চাইলে আমি স্বাভাবিকভাবেই প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ব্যাখাটিই প্রদান করি। ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া এর বাইরে অন্য কোন ব্যাখ্যা প্রদান করা এ মুহুর্তে সম্ভব নয়। তাই একজন গবেষক হিসাবে আমি হুয়েল বিচিং এর কারণ হিসাবে ‘সামাজিক দায়িত্ববোধ’ এর ধারণাটিই প্রকাশ করেছি মাত্র।

কিন্তু এ সম্পর্কে মিডিয়ায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য বা ব্যাখ্যা না থাকায় পাঠকদের মাঝে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। আর এ বিভ্রান্তি নিরসনেই আমি এ তথ্য তুলে ধরলাম। প্রয়োজনে ‘তিমির আত্মহত্যা’ শিরোনামে গুগলে সার্চ দিয়েও খুঁজতে পারেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন

কমেন্ট করুন

আরো সংবাদ পড়ুন
themesba-lates1749691102