জাতীয় জীবনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়েছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে তাই আমরা গর্বিত হতে পারি। দীর্ঘ এই ৫০ বছরে আমাদের খেলাধুলায় সাফল্যের গল্প নেহাত কম নয়। মেয়েদের খেলাধুলাও ব্যতিক্রম নয়, মেয়েরা অনেকটা পথ এগিয়েছে। তবে মেয়েদের খেলায় প্রত্যাশিত উন্নতি হয়েছে কি না, সে বিরাট প্রশ্ন। সত্যি বলতে, আমাদের দেশে মেয়েদের খেলায় এখনো রয়ে গেছে বাধার স্তূপ।
প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই। যদিও ফোর-জি যুগে রয়েছি আমরা, সবকিছুই এখন আধুনিক। আমাদেরই দুইজন নারী এভারেস্ট জয় করেছেন। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়েও মেয়েদের খেলাধুলায় আসতে দিতে চায় না পরিবার। আর পরিবার উৎসাহী না হলে একটি মেয়ের পক্ষে খেলাধুলায় আসা বা খেলাধুলা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভবই।
একসময় খেলাধুলায় অনেক সচ্ছল পরিবারের মেয়েরা আসত। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক মেয়ে খেলতেন। কিন্তু এখন সেই ধারাটা অনেক কমে গেছে। এখন নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাই বেশি আসছেন খেলায়। তাঁদের লক্ষ্য কোনো একটি সংস্থায় চাকরি পাওয়া। সেই চাকরি থেকে প্রাপ্ত আয়ে সংসার চালানোর কঠিন সংকল্প নিয়েই খেলায় নাম লেখানো। কিন্তু খুব বেশি অর্থ কি খেলাধুলা করে পায় আমাদের মেয়েরা? পায় না। ফলে খেলার প্রতি তাদের উৎসাহ কমে যায়। মেয়েরা জানে, খেলায় এলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না। খেলার প্রতি ঝোঁকটা কমে যাওয়ার এটিও একটা কারণ।
অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে না পারলে মেয়েদের খেলাধুলা বেশি দিন টিকবে না। এ কথা আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি। মেয়েরা খেলাধুলায় খুব বেশি আসবেও না সামনে। কেননা, বর্তমানে জীবনের বাস্তবতা অনেক কঠিন। জীবিকার জন্য মেয়েরা খেলা থেকে ভালো অর্থ না পেলে নিরুৎসাহী হবেই। সুতরাং মেয়েদের পারিশ্রমিক বাড়াতে হবে। আর্থিক ব্যাপারটা বাড়ানো গেলে আরও বেশি মেয়ে খেলায় আসবে আমার বিশ্বাস। স্পনসরদের উচিত মেয়েদের খেলাধুলার পাশে দাঁড়ানো। অথচ সব সময় দেখা যায়, ছেলেদের বড় বড় টুর্নামেন্ট (ফুটবল, ক্রিকেট) টাকা দেয় স্পনসর। ছোট ছোট খেলা স্পনসর করতে চায় না। ফলে ছোট খেলার ছেলেমেয়েদের আর্থিক যোগটা সেভাবে হয় না।
মেয়েরা খেলাধুলা করলে চেহারা নষ্ট হয়ে যাবে। আর চেহারা নষ্ট হয়ে গেলে ভালো বিয়ে দেওয়া যাবে না—এমনটা মনে করে অনেক পরিবার। এটিও বড় বাধা মেয়েদের এগিয়ে চলার পথে। তা ছাড়া মেয়েদের খেলাধুলার উপযোগী পরিবেশও কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? উত্তরে বলব, আগের তুলনায় পরিবেশ হয়তো কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে প্রত্যাশিত মাত্রায় যায়নি। পাশাপাশি স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে যে টুর্নামেন্টই হতো, মেয়েদের অংশগ্রহণও চোখে পড়ত। এখন এই টুর্নামেন্টগুলো হারিয়েই গেছে বলা যায়।
লেখক: টেবিল টেনিস খেলোয়াড়। ১৬ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্থান পেয়েছেন গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে।
একই সঙ্গে খেলাধুলায় মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা বেড়েছে। আমাদের সময় মেয়েদের নিরাপত্তা অনেক ভালো ছিল। ঘটনা-দুর্ঘটনার কথা শোনা যেত না, এখন শোনা যাচ্ছে। কারণ, এখন বেশির ভাগ মেয়েই পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে আসা, প্রতিবাদের সাহস তাদের থাকে না। ফলে মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে। আগে খেলাধুলায় সচেতন মেয়ে বেশি থাকায় তাদের সঙ্গে এ ধরনের কাজকর্ম করার সাহস কমই পেতেন সংগঠকেরা। কিন্তু এখন মেয়েরা ভয়ে চুপ থাকে বেশি। ওরা মনে করে প্রতিবাদ করলে খেলার সূত্রে পাওয়া চাকরিটা যদি চলে যায়! তাহলে সংসার চলবে কীভাবে? সবকিছু মেনে নিয়েই খেলায় থেকে যায় মেয়েরা।
তবে একসময় যেখানে ঘরে বন্দী ছিল আমাদের মেয়েরা, খুব কমসংখ্যক মেয়ে খেলাধুলায় আসত, এখন মেয়েরা ঘরে বন্দী নেই। ফলে খেলাধুলায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। এটা ভালো দিক। মেয়েরা ফুটবল খেলছে। সত্তর দশকে শুরু হওয়া হকিচর্চা মাঝখানে অনেক বছর বন্ধ থাকলেও আবার তা চালু হয়েছে। নারী হকি টুর্নামেন্ট হচ্ছে। বিদেশেও আন্তর্জাতিক হকি খেলে এসেছে বাংলার মেয়েরা। আশির দশকে মেয়েদের ক্রিকেট শুরু। অনেক বছর বন্ধ থাকার পর এই খেলাগুলো ফের মাঠে ফিরেছে। ছেলেরা যা পারেনি, তা করে দেখিয়েছে আমাদের মেয়েরা। ওরা জিতেছে টি–টোয়েন্টি এশিয়া কাপ ক্রিকেট। কদিন আগেই তো বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল টেস্ট স্ট্যাটাস পেল। বয়সভিত্তিক নারী ফুটবলে এশিয়ার সর্বোচ্চ স্তরে খেলেছে মেয়েরা।
তারপরও বলব, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, দাবার মতো ঘরোয়া (ইনডোর) খেলাগুলো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও প্রত্যাশিত জায়গায় যেতে পারেনি এই খেলাগুলো। মেয়েদের জন্য প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধাও সেভাবে বাড়ানো যায়নি। তা ছাড়া মেয়েদের সামনে আদর্শ নারী ক্রীড়াবিদের অভাবও রয়েছে। তারপরও রোল মডেল হিসেবে যদি আপনি কারও নাম বলেন আজকের মেয়েদের সামনে, অনেক মেয়েই তা মানতে চায় না। আমাদের সময় আমরা বলতাম, ‘অমুকের’ খেলা আমার ভালো লাগে। কিন্তু এখনকার মেয়েরা এগুলো বলতে নারাজ। রোল মডেল হিসেবে কাউকে স্বীকার করতে তাদের দ্বিধা দেখেছি।
তবে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের মেয়েদের খেলাধুলা নিয়ে আমি হতাশ নই। আশাবাদীই থাকতে চাই। করোনার কারণে খেলাধুলা অনেক দিন স্থবির ছিল। আবার তা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ গেমসে ভালো করুক আমাদের মেয়েরা, সেই প্রত্যাশাই রাখছি।
কমেন্ট করুন